ইতিহাসের নায়ক মহাবীর তিতুমীর
তিতুমীর, যাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী। তিনি ওয়াহাবী আন্দোলন এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও তার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় এই বাঁশের কেল্লাতেই তার মৃত্যু হয়।
মীর নিসার আলী তিতুমীর |
জন্ম: ২৭শে জানুয়ারি, ১৭৮২
উত্তর 24 পরগনা
মৃত্যু: ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ (বয়স ৪৯)
বাঁশের কেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া
পেশা: বিপ্লবী, মুক্তিযোদ্ধা
আন্দোলন: বাঁশের কেল্লা
পিতা-মাতা: সৈয়দ মীর হাসান আলী (পিতা)
আবিদা রুকাইয়া খাতুন (মাতা)
তেতো, তিতু, তিতুমীর। শুনতে বেশ অবাক লাগছে, তাই না? তা হলে খুলেই বলি। ১৭৮২ সাল। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলা। সে জেলার বশিরহাট মহকুমার একটি গ্রাম চাঁদপুর (মতান্তরে হায়দারপুর)। এ গ্রামে বাস করত এক বুনিয়াদি মুসলিম পরিবার। সৈয়দ বংশ। এই বংশে জন্ম নেয় এক শিশু। ছোট্ট শিশুটি ছিল যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি বলিষ্ঠ তার গড়ন। শিশুটি ছিল খুব জেদি। শিশুকালে তার এক বার কঠিন অসুখ হলো। রোগ সারানোর জন্য তাকে দেওয়া হলো ভীষণ তেতো ঔষধ। এমন তেতো ঔষধ শিশু তো দূরের কথা বুড়োরাও মুখে নেবে না। অথচ এই ছোট্ট শিশু বেশ খুশিতেই খেল সে ঔষুধ। প্রায় দশ-বারো দিন এই ওষুধ খেলে সে। বাড়ির লোকজন সবাই অবাক। এ কেমন শিশু, তেতো খেতে তার আনন্দ! এর জন্য ওর ডাক নাম রাখা হলো তেতো। তেতো থেকে তিতু। তার সাথে মীর লাগিয়ে হলো তিতুমীর। তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী।
শহিদ তিতুমী |
তিতুমীরের যখন জন্ম, তখন আমাদের বাংলাদেশসহ পুরো ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন। চলছে ব্রিটিশ রাজত্ব। ইংরেজরা চালাত অত্যাচার। অন্যদিকে ছিল দেশি জমিদারদের জুলুম। ইংরেজ কর্মচারীরা ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে দারুন দাপটে। তিতুমীর এসব দেখতেন আর ভাবতেন, এদের হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে দেশের মানুষ।
তিতুমীরের গ্রামে ছিল একটি মাদ্রাসা। সেখানে শিক্ষক হিসেবে এলেন ধর্মপ্রাণ এক হাফেজ। নাম তাঁর হাফেজ নেয়ামত উল্লাহ। তিতুমীর এই মাদ্রাসায় পড়তেন। তিনি অল্প সময়েই নেয়ামত উল্লাহ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন।
সেকালে গ্রামে গ্রামে ডনকুস্তি আর শরীরচর্চার ব্যায়াম হতো। শেখানো হতো মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, তীর ছোঁড়া আর অসিচালনা। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ তাড়ানোর জন্য গায়ে শক্তি সঞ্চয় করা। তিনি ডনকুস্তি শিখে কুস্তিগির ও পালোয়ান হিসেবে নাম করলেন। লাঠিখেলা, তীর ছোঁড়া আর অসি পরিচালনাও শিখলেন। তাঁর অনেক ভক্তও জুটে গেল। তিতুমীরের গায়ে শক্তি ছিল প্রচুর। কিন্তু তিনি ছিলেন শান্ত ও ধীর স্বভাবের।
একবার ওস্তাদের সঙ্গে তিনি বিহার সফরে বেরোলেন। মানুষের দূরবস্থা দেখে তাঁর মনে দেশকে স্বাধীন করবার চিন্তা এলো। তিনি মুসলমানদের সত্যিকারের মুসলমান হতে আহ্বান জানালেন। আর হিন্দুদের বললেন অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। হিন্দু-মুসলমান সকলে তার কথায় সাড়া দিলেন।
১৮২২ সাল। তিতুমীরের বয়স তখন চল্লি। তিনি হজ পালন করতে গেলেন মক্কায়। সেখানে পরিচয় হলো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হযরত শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভী সঙ্গ। তিনি ছিলেন সংগ্রামী পুরুষ এবং ধর্মপ্রাণ। তিতুমীর তাঁর শিষ্য হলেন। দেশে ফিরে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন। ডাক দিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে, নীলকরদের রুখতে আর নিজেদের সংগঠিত হতে। কিন্তু প্রথম বাধা পেলেন জমিদারদের কাছ থেকে। তাঁর ওপর অত্যাচার শুরু হলো। নিজ গ্রাম ছেড়ে তিনি গেলেন বারাসাতের নারকেলবাড়িয়ায়। নারকেলবাড়িয়ার লোকজন তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলো। হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তৈরি করলেন এক দুর্ভেদ্য বাঁশের দুর্গ। এটাই নারকেলবাড়িয়ার 'বাঁশের কেল্লা'। তাঁর এই কেল্লায় সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল ৪-৫ হাজার। চব্বিশ পরগনা, নদীয়ার আর ফরিদপুর জেলা তখন তাঁর দখলে। ইংরেজদের কোন কর্তৃত্ব রইল না এসব অঞ্চলে। এই দুর্গে তিনি তাঁর শিষ্যদের লড়াইয়ের শিক্ষা দিতে লাগলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করার কৌশল ও প্রস্তুতি শিখাতে লাগলেন। এ খবর চলে গেল ইংরেজ শাসকদের কাছে। ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলালো দেশি জমিদাররা। ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার কে পাঠানো হয় তিতুমীরকে দমন করার জন্য। কিন্তু আলেকজান্ডার তাঁর সিপাহি বাহিনী নিয়ে পরাস্ত হন তিতুমীরের হাতে। তারপর তিতুমীর কয়েকটি নীলকুঠি দখল করে নেন।
বাঁশের কেল্লা |
১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তখন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল। তিতুমীরকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি পাঠালেন বিরাট সেনাবহর আর গোলন্দাজ বাহিনী। এর নেতৃত্ব দেওয়া হলো সেনাপতি কর্নেল স্টুয়ার্ডকে। স্টুয়ার্ড আক্রমণ করলেন তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। তখন ভালো করে ভোর হয়নি। আবছা আলো। স্টুয়ার্ডের ছিল হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য আর অজস্র অস্ত্র-গোলাবারুদ। তিতুমীরের ছিল মাত্র চার-পাঁচ হাজার স্বাধীনতা প্রিয় সৈনিক। তাঁর না ছিল কামান, না ছিল গোলাবারুদ, বন্ধুক। তবে তাঁদের মনে ছিল পরাধীন দেশকে স্বাধীন করবার অমিত তেজ।
প্রচন্ড যুদ্ধ হলো। তিতুমীর আর তাঁর বীর সৈনিকরা প্রাণপণ যুদ্ধ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ইংরেজ সৈনিকদের গোলার আঘাতে ছারখার হয়ে গেল নারকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা। শহিদ হলেন বীর তিতুমীর। শহিদ হলেন অসংখ্য মুক্তিকামী বীর সৈনিক। তিতুমীরের ২৫০ জন সৈন্যকে ইংরেজরা বন্ধিি করল। কারো হলো কারাদণ্ড, কারো হলো ফাঁসি। এভাবেই শেষ হলো যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধের বীর নায়ক তিতুমীর অমর হয়ে রইলেন এ দেশের মানুষের মনে। আজ থেকে প্রায় পৌনে দু শ বছর আগে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর তিতুমীরই হলেন বাংলার প্রথম শহীদ।
সম্মাননা: তিতুমীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ জিন্না কলেজ কে তার নাম অনুসারে সরকারি তিতুমীর কলেজ নামকরণ করা হয়। তার নামে বুয়েট এ একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তিতুমীর হল। বিবিসির জরিপে তিনি ১১তম শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি জাহাজের নামকরণ করা হয় বিএনএস তিতুমীর।
- হযরত মুহাম্মদ (স) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী || biography of the Hazrat Muhammad (peace be upon him)
- Biography of Sheikh Mujibur Rahman ।। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী
- আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী | Biography of Abdul Hamid Khan Bhashani
Post a Comment