বেগম রোকেয়া নারী জাগরনের অগ্রদূত


বেগম রোকেয়ার


বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ (১৮৮০-১৯৩২) সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক এবং নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ ইউনিয়নে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার পূর্বপুরুষগণ মুগল আমলে উচ্চ সামরিক এবং বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োজিত ছিলেন। বিয়ের পরে তাঁর নাম হয় রোকেয়া  সাখাওয়াৎ হোসেন। তবে তিনি বেগম রোকেয়া নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন।

Begum Rokeya

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন হলেন একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বিবিসি বাংলার 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি' জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকিয়া। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লেষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল সক্রিয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

বেগম রোকেয়ার কর্ম ও আদর্শ উদযাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর ৯ই ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস উদযাপন করে এবং বিশিষ্ট নারীদের অনন্য অর্জনের জন্য বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করেন।


জন্ম: ৯ ডিসেম্বর,১৮৮০ পায়রাবন্দ, মিঠাপুকর, রংপুর। 

মূত্যু: ৯ ডিসেম্বর,১৯৩২। কলকাতা 

দাম্পত্যসঙ্গী: সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন

রোকেয়া ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীর মোহাম্মদ আবু আলী সাবের প্রভূত ভূসম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। পায়রাবন্দ গ্রামে তাঁদের বাড়িটি ছিল বিশাল। সাড়ে তিন বিঘা জমির মাঝখানে ছিল তাঁদের বাড়িটি।

বেগম রোকেয়ার পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল। রোকেয়ার বড় দু'ভাই মোঃ ইব্রাহীম ও খলিলুর রহমান আবু ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তাঁরা কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যায়ন করেন। ফলে ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে এবং তা তাদের চিন্তা-চেতনা কে প্রভাবিত করে। বড় বোন করিমুন্নেসা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও ভাইদের সহায়তায় তিনি বাড়িতে পড়াশোনার সুযোগ লাভ করেন। সামাজিক ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে রচিত তার কবিতা সমকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। বেগম রোকেয়ার শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দু'ভাই ও বোন যথেষ্ট অবদান ছিল।

রোকেয়া যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সময়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ছিল না। ফলে মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি, সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। মেয়েদের অবস্থান ছিল খুবই শোচনীয়। পর্দাপ্রথা কঠোরভাবে মানা হতো বলে মেয়েদের শিক্ষা লাভের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু মেধাবী রোকেয়া প্রবল আগ্রহ ছিল লেখাপড়ার প্রতি।

রোকেয়ার বড় দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। বোনদের আগ্রহ দেখে বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের বোন করিমুন্নেসা ও রোকেয়াকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। করিমুন্নেসার অনুপ্রেরণায় রোকেয়া বাংলা সাহিত্য রচনা ও চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রোকেয়া তাঁর রচিত 'মতিচূর' দ্বিতীয় খন্ড করিমুন্নেসাকে উৎসর্গ করেছিলেন। উৎসর্গ-পত্রে তিনি লিখেছিলেন, 'আপাজান! আমি শৈশবে তোমারি স্নেহের প্রসাদে বর্ণপরিচয় পড়িতে শিখি। অপর আত্নীয়গণ আমার উর্দু ও ফারসি পড়ায় তত আপত্তি না করিলেও বাঙ্গালা পড়ার ঘর বিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাংলা পড়ার অনুকূলে ছিলেন।' নানা বাধা এড়িয়ে রোকেয়া আপন সাধনায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একজন অসাধারণ নারী।

১৮৯৮ সালে কিশোরী বয়সেই বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি তাঁর পড়াশোনার চর্চা চালিয়ে যান। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সাথে রোকেয়া
স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সাথে রোকেয়া

সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'নবপ্রভা' পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রথম রচনা 'পিপাসা'। বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচনার নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। ১৯০৫ সালে প্রথম ইংরেজি রচনা 'সুলতানাস ড্রিম' মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। তাঁর রচনার সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

১৯০৯ সালে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। রোকেয়া ভাগলপুরে তাঁর নামে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তখন স্কুলের ছাত্রী ছিল পাঁচ জন। ১৯১১ সালে এই স্কুলটি তিনি কলকাতায় স্থানান্তর করেন। শুরুতে ছাত্রী সংখ্যা আট জন। আস্তে আস্তে স্কুলে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল
সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল


রোকেয়া বাঙালি মুসলমান মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য শুধু স্কুলই প্রতিষ্ঠা করেন নি, ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য বাবা-মায়ের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন। এই কাজে তিনি ছিলেন একজন নিরলস পরিশ্রম কর্মী। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে নারীশিক্ষার অগ্রগতি সূচিত হয়। মেয়েরা ধীরে ধীরে শিক্ষার আলোর দিকে এগোতে থাকে।

১৯১৫ সালে তিনি 'আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম' নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে দুস্থ নারীদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করা হতো। তাদের হাতের কাজ শেখানো হতো, সামান্য লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। এক কথায় এই সংগঠনটির লক্ষ ছিল সমাজের সাধারণ দুস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা।


রোকেয়ার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি: 

'মতিচূর' প্রথম খন্ড (১৯০৪), 

'সুলতানাজ ড্রিম' (১৯০৮), 

'মতিচূর' দ্বিতীয় খন্ড (১৯২২)

'পদ্মরাগ' (১৯২৪)

'অবরোধবাসিনী' (১৯৩১) 


রোকেয়া এই উপমহাদেশের একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। নারীশিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে সমগ্র বাঙালি সমাজের তিনি শ্রদ্ধেয়। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় তিনি দুইভাবে নারীদের মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন।

১. মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করে,

২. নিজের রচনায় নারী মুক্তির দিক নির্দেশনা দেয়।


তিনি ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


স্বীকৃতি:

  • বেগম রোকেয়ার নামে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬০ এর দশকে ছাত্রীনিবাস 'রকেয়া হল' খোলা হয় যার নাম আগে ছিল 'ইউমেন্স হল'। 
  • বাংলাদেশের ৭ম বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে 'নারী জাগরণের অগ্রদূত' হিসেবে তার নামকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করেন।
  • মহিয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য আবাসিক হল "রোকেয়া হল" নামকরণ করা হয়।
  • প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তার জন্মদিনে "বেগম রোকেয়া দিবস" পালন করা হয় এবং নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদেরকে "বেগম রোকেয়া পদক" প্রদান করা হয়।
  • ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দু'টি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
  • তার ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাদের হোমপেজে বেগম রোকেয়ার গুগোল ডুডল প্রদর্শন করে তার জন্মদিন উদযাপন করে। গুগোল ডুডলটিতে দেখা যায় সাদা পোশাকে চশমা পরা বেগম রোকিয়া বই হাতি হেঁটে যাচ্ছেন।

Eponyms:


  • Begum Rokeya Day, a commemoration of the birth and death anniversary of Rokeya, observed annually on 9 December in Bangladesh.
  • Begum Rokeya Padak, a Bangladeshi National honour conferred on individual women for their exceptional achievements
  • Begum Rokeya Memorial Center, an academic and cultural hub in Pairaband, Bangladesh.
  • Rokeya Shoroni, a road in Dhaka.
  • Begum Rokeya University, a public state University in Banglades. 
  • Rokeya Hall, the largest female residential hall of the University of Dhaka 

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র:

রোকিয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মরণে, বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পৈতৃক ভিটায় ৩.১৫ একর ভূমির উপর নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। এতে অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউস, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরী ইত্যাদি রয়েছে। বেগম রোকেয়ার এই স্মৃতি কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়।



2 Comments

  1. Very good, she is a legend, but sorry to say still our awareness is not so good both male and female education,

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post