মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী
আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যিনি মাওলানা ভাসানী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে "মজলুম জননেতা" হিসাবে সমধিক পরিচিত। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওপন্থী কম্যুনিস্ট, তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাই তার অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাকে "লাল মওলানা" নামেও ডাকতেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের 'আসসালামু আলাইকুম' বলে প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের ঐতিহাসিক ঘন্টা বাজিয়েছিলেন।
জন্ম: ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ - ধানগড়া, সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ।
মৃত্যু: ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ - ঢাকা, বাংলাদেশ
অন্যান্য নাম:
- লাল মাওলানা
- মাওলানা ভাসানী
প্রতিষ্ঠান:
- আওয়ামী মুসলিম লীগ
- ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি
আন্দোলন:
- খেলাফত আন্দোলন
- অসহযোগ আন্দোলন
- বাংলা ভাষা আন্দোলন
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
- ফারাক্কা লংমার্চ
দাম্পত্য সঙ্গী: আলেমা খাতুন
পুরস্কার: স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৭৭
আব্দুল হামিদ খান ভাসানী |
বাংলার কৃষক - মজুর - শ্রমিক এর অতি আপনজন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। চিরকাল নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। মজলুম মানুষের সুখে দুঃখে কাঁদে কাঁধ মিলিয়ে তাদের কথা বলেছেন। সংগ্রাম করেছেন। এজন্য তিনি মজলুম জননেতা।
সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে আব্দুল হামিদ খান এর জন্ম হয় ১৮৮০ সালে। তাঁর বাবার নাম হাজী শরাফত আলী খান। মায়ের নাম মোসাম্মৎ মজিরন বিবি। অল্প বয়সেই তিনি পিতৃ-মাতৃহীন হন। তাঁর এক চাচা ইব্রাহীম খান তাঁকে শৈশবে আশ্রয় দেন। এই চাচার কাছ থেকেই তিনি মাদ্রাসার পড়াশোনা করেন। এই সময় তিনি ইরাক থেকে আগত এক পীর সাহেবের স্নেহদৃষ্টি লাভ করেন। তিনি তাঁকে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। এই সময় তিনি দেশাত্মবোধে উদৃদ্ধ হন।
মাদরাসার পড়া শেষ করে তিনি টাঙ্গাইলের কাগমারির এক প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে শিক্ষকতার সময় তিনি জমিদারের অত্যাচার-নির্যাতন দেখতে পান। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম শুরু করেন। ফলে জমিদারের বিষ নজরে পড়ে তাঁকে কাগমারি ছাড়তে হয়।
২২ বছর বয়সে কংগ্রেস নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আদর্শে তিনি অনুপ্রাণিত হন। পরে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরপর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৭ মাস পর তিনি মুক্তি পান। এরপর ১৯২৪ সালে সিরাজগঞ্জে তিনি এক সবাই ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি কৃষক সাধারণের ওপর জমিদারদের শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরেন। এই সভায় ভাষণের জন্য তাঁকে নিজের জন্মভূমি ছাড়তে হয়। তিনি এবার চলে যান আসামের জলেশ্বরে। এ বছরই আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসানচরে তিনি এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সভায় তিনি বাঙালি কৃষকদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এই সমাবেশেই সাধারণ কৃষকরা তাঁকে ভাসানচরের মওলানা নাম দেন। পরে তাঁকে ভাসানী নাম দেয়। তখন থেকেই তাঁর পরিচয় হয় মওলানা ভাসানী। মাওলানা ভাসানী এদেশে একটি প্রিয় নাম।
মাওলানা ভাসানী তাঁর এক ভাষণে বলেছেন, 'আমি খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলি। এই মানুষেরা কাজ করে খেতে খামারে, কাজ করে কলে-কারখানায়। এরা কৃষক-শ্রমিক। আর এরাই জমিদার, মহাজন, মালিকের জুলুমের শিকার হয়।'
মূলত সারা জীবন তিনি এই নিপীড়িত মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি আসাম থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সংগঠনের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। তিনি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে বাস করতে শুরু করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে তিনি আবার গ্রেফতার হন।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়।
১৯৫৭ সালে ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারিতে এক বিশাল আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলন 'কাগমারি সম্মেলন' নামে খ্যাত। সম্মেলনে যোগ দেন দেশ-বিদেশের বহু মানুষ। এই সম্মেলনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেন।
মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে শাসকরা ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে পূর্ব বাংলার মানুষকে শোষণ করছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে তিনি পল্টন ময়দানে ভাষণ দেন। এই ভাষণে শোষণের এই কথাটিই বারবার উচ্চারণ করে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন পাকিস্তানি সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাচ্ছে, এরূপ চলতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তান একদিন স্বাধীন দেশ হয়ে যাবে।
মাওলানা ভাসানীর ভাষণ |
১৯৭১ সালের ২৫এ মার্চ মধ্যরাত থেকে দেশব্যাপী পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মওলানা ভাসানীর টাঙ্গাইলের ঘরবাড়ি পাকিস্তানি সৈন্যরা পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি ভারতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার পরও কোন পদমর্যাদা ও মোহ তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারে নি। তিনি সবসময় জনগণের পাশে থেকে বিভিন্ন জনমুখী কর্মসূচি পালন করেন।
মওলানা ভাসানী নিজে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করতে পারে নি। কিন্তু এ দেশের মানুষের শিক্ষা প্রসারে তার অনেক অবদান ছিল। তিনি সন্তোষে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, মহীপুরে হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, ঢাকায় আবুজর গিফারি কলেজ এবং টাঙ্গাইলে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৬ সালের ১৭ ই নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৯৬ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটি যুগের অবসান ঘটে। তাঁকে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাজার |
মওলানা ভাসানীর জীবন থেকে আমরা প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেম, প্রগতিশীল আদর্শ ও প্রতিবাদী চেতনা শিক্ষা পাই। তিনি চিরকাল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।
সম্মাননা: ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির তালিকায় তিনি ৮ম হন।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
- দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)
- মাও সে তুং-এর দেশ(১৯৬৩)
মওলানা ভাসানীর সেই বিখ্যাত উক্তি গুলি:
তার বিখ্যাত উক্তির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে "আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।"
"আমার শেষ সংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভারতের সহিত কনফেডারেশন। এই তিন কাজের সাধন ইনশাল্লাহ আমার জীবিতকালে দেখার প্রবল ইচ্ছা অন্তরে পোষণ করি।"
- হযরত মুহাম্মদ (স) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী || biography of the Hazrat Muhammad (peace be upon him)
- Biography of Sheikh Mujibur Rahman ।। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী
Post a Comment